বাংলাদেশে ছাত্র বিক্ষোভে হামলার দু’বছর পরও অপরাধীদের দায়মুক্তি
চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের দু’বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অধিকারহরণের ঘটনাগুলো এখনো জবাবদিহির বাইরে রয়ে গেছে।
‘ছাত্র বিক্ষোভ দমন’ শিরোনামে সিভিল সোসাইটি গ্রুপ ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডারস, সিভিকাস ও সাউথ এশিয়ান হিউম্যান রাইটস (এসএএইচআর)- এর উদ্যোগে আজ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিক্ষোভের সময় বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও ধরপাকড়ের পাশাপাশি নির্যাতন ও দৃর্ব্যবহারের অভিযোগ এবং শিক্ষার্থীদের উপর নন-স্টেট পক্ষগুলোর বেপরোয়া আক্রমণের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
রিপোর্টের সারসংক্ষেপ ডাউনলোড করুন
২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে পথে নামে। তিনমাস পর জুলাই-আগস্টে সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী মৃত্যুর জেরে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা গণপরিবহনে নিরাপত্তার দাবিতে বিক্ষোভে মেতে ওঠে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ দুটি আন্দোলনেরই জবাব দেয়, মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। আন্দোলনকারীরা জানায়, পুলিশ তাদের টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট ও জলকামান দিয়ে আক্রমণ করে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত সশস্ত্র ব্যক্তিরা নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে মাঠে নামে এবং লাঠিশোটা, রড ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। তারা সামাজিক মাধ্যমকে আন্দোলনে নেতৃত্ব ও সংগঠকদের ভয়ভীতি, হয়রানি ও হুমকি দিতে কাজে লাগায়।
ঢাকার সদরঘাটে অবস্থিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের একজন কর্মী জানান, ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ছাত্রলীগের কর্মীরা তাকে আক্রমণ করে। তিনি বলেন: "তারা আমাকে টেনে-হিঁচড়ে এক কোণায় নিয়ে যায়। সেখানে ১২ জন ছিল। সবাই মিলে মারধর করে আমার ঠোঁট কেটে দেয়। আমি অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা মারতে থাকে এবং একপর্যায়ে আমাকে সেখানে ফেলে রেখে যায়।"
পুলিশ আন্দোলনকারীদের নির্বিচারে ধরপাকড় করে। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা করা হয় কারো নামোল্লেখ না করে; এরপর খেয়ালখুশি মতো শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করা হয়। আটকাবস্থায় নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন অনেকে।
ঢাকার ভাষানটেক এলাকার একজন আন্দোলনকারী ২০১৮ সালের ১লা জুলাই গ্রেফতার হন। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে দিনভর নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘তারা হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় আমাকে মেঝেতে শুইয়ে দেয়। এরপর কয়েকজন পুলিশ আমাকে রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। মেঝেতে আমার রক্ত ঝরতে থাকে। পরে অন্য বন্দীদের দিয়ে ওই রক্ত পরিষ্কার করায়।”
আন্দোলন সম্পর্কে সরকারি ভাষ্যের বাইরে নিরপেক্ষ তথ্যপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত করতে ও সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে সরকারের চেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশী সাংবাদিকদেরও নির্যাতন ও গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতদের একজন ৬৩ বছর বয়সী খ্যাতনামা ফটো সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম। ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট কাতার ভিত্তিক টেলিভেশন চ্যানেল ‘আল জাজিরা'কে ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মাথায় সাদা পোশাকধারী পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে এবং একদিন পর তাঁকে ‘মিথ্যা’ ও ‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০১৩-তে গ্রেফতার দেখানো হয়। পুলিশের হেফাজতে থাকাকালে মারধরের শিকার হন বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও সাউথ এশিয়ান হিউম্যান রাইটস-এর চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, "আন্দোলনকারীদের উপর সহিংসতার জন্য দায়ী কাউকে বিচারের মুখোমুখি করতে না পারা থেকেই বাংলাদেশে বিচারহীনতার বিষয়টি কতো গভীরে প্রেথিত তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ ও নন-স্টেট পক্ষের সহিংসতার সব অভিযোগের দ্রুত ও স্বাধীন তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাই।’’
সাউথ এশিয়ান হিউম্যান রাইটস ভারতের ব্যুরো সদস্য ও যৌথ আন্তর্জাতিক মিশনে অংশগ্রহণকারী মানবাধিকার সংগঠক রশ্মী গোস্বামী বলেন, "পুলিশকে অবশ্যই ছাত্র, মানবাধিকারকর্মী ও আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং মতপ্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার চর্চার কারণে আন্দোলনকারী ও অন্যান্যদের সাজার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করতে হবে।’’
২০১৮ সালে নির্বাচনের পূর্বে ছাত্র আন্দোলনের কঠোর দমনপীড়নের এসব ঘটনা ঘটে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে কি পরিমাণ খড়গহস্ত ছিল, কতোটা বেপরোয়া তারা হতে পারে।
শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি থেমে যাবার পর বহুদিন পরও অনেক আন্দোলানকারী শিক্ষার্থী ও তাদের বন্ধু, পরিবারের সদস্যরা নজরদারি, ভয়ভীতি ও হয়রানির শিকার হচ্ছে; যা কার্যত ভবিষ্যতে সরকারের বিরুদ্ধে ভিন্নমতের সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থনদানকারী মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা ও ভয়ভীতি দেখাতে সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতিবাদ-বিক্ষোভ থেমে যাবার পরও ছাত্র আন্দোলনের একজন সংগঠকের উপর ৮ বার হামলা চালানো হয়েছে। আন্দোলনের আরেক সংগঠকের উপর নিয়মিত নজরদারি বজায় রেখেছে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।
ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডারস-এর নির্বাহী পরিচালক এন্ড্রু এন্ডারসন বলেন, ‘‘বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই আন্দোলনের সংগঠক, অংশগ্রহণকারী ও সমর্থনদাতাদের প্রতি সব ধরণের হয়রানি, ভয়ভীতি ও নজরদারি বন্ধ করতে হবে এবং প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজনকারী যাতে কোনোরকম প্রতিহিংসার আশঙ্কা ছাড়াই কর্মকাণ্ড চালাতে পারে তার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’’
ভিন্নমত দমনে সরকারের সমালোচকদের প্রতি আগ্রাসন ও আক্রমণের যে ধরণ চালু রয়েছে, ছাত্র বিক্ষোভে দমনপীড়ন থেকে তার ইঙ্গিত মিলে। বর্তমানে বিলুপ্ত ইনফরমেশন কমিউনিকেশন অ্যান্ড টেকনোলজি (আইসিটি) আইন ও তার স্থলাভিষিক্ত হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮, কে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনে প্রয়োগ করা হয়েছে। মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও ভিন্নমতাবলম্বীরা সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় মামলার শিকার হয়েছে, সাজা খেটেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে জোরপূর্বক গুম হয়ে গেছে।
সিভিকাসের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড ক্যাম্পেইনস লিড ডেভিড কোডে বলেন, ‘‘মতপ্রকাশের অনেকগুলো ধরণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এ আইনে ভিন্নমত প্রকাশের জন্য চড়া অঙ্কের অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।’’
এ প্রতিবেদনে ছাত্র-বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে বিষয়গুলো বিবৃত হয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের সংবিধানের পরিপন্থী। একইসঙ্গে বিষয়গুলো ইন্টারন্যাশনাল কোভন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর), ইউএন কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চার অ্যান্ড আদার ক্রুয়েল, ইনহিউম্যান অর ডিগ্রেডিং ট্রিটমেন্ট অর পানিশমেন্ট ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং মানদণ্ডের প্রতি বাংলাদেশের দায়বদ্ধতারও লঙ্ঘন।
…………………………………………………………………………………
ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডারস : আয়ারল্যান্ড ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন যা বিশ্বজুড়ে ঝুঁকিতে থাকা মানবাধিকার কর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় কাজ করে থাকে।
সিভিকাস: ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন হলো নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলোর একটি বৈশ্বিক জোট যার সদর দফতর জোহানেসবার্গে। বিশ্বজুড়ে নাগরিক সক্রিয়তা ও নাগরিক সমাজ জোরদারে এই জোট অঙ্গীকারাবদ্ধ।
সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (এসএএইচআর): জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সোচ্চার ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি গণতান্ত্রিক আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক। আঞ্চলিক ঘটনায় প্রতিক্রিয়া, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পর্যবেক্ষণ, মানবাধিকার প্রতিকূল প্রভাব রাখা আইন, নীতি ও চর্চা পর্যালোচনা এবং এ অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে প্রচারণা ও কর্মসূচির মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, সুশাসন ও ন্যায়বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এসএএইচআর ভূমিকা রাখে।